LOADING

দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুরে করম পূজো পালিত হল|

Spread the love

দক্ষিণ ২৪ পরগণার সোনারপুরে করম পূজো পালিত হল|

গত ২৫ ও ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ চব্বিশ পরগনা আদিবাসী জনকল্যাণ সমিতির উদ্যোগে ও পরিচালনায় দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলার সোনারপুর পূর্ব শীতলায় সাড়ম্বরে উদযাপিত হল আদিবাসীদের জাতীয় উৎসব করম (কারাম) পূজো ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান| অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সোনারপুর ব্লকের বিডিও মাননীয় সৌরভ ঢাল্লা, সোনারপুর ২ নং গ্রাম পঞ্চায়েতর সচিব মাননীয় সঞ্জীব কান্ডার, অধ্যাপক মাননীয় দেবব্রত সিংহ, কবি ও সাংবাদিক মাননীয় গালিব ইসলাম, নাট্যকার মাননীয় মদনমোহন সরদার, সংগীত শিল্পী মাননীয় হরিপদ সরদার, সমাজসেবী মাননীয় গোপাল চন্দ্র সাঁফুই, সাদরি কবি মাননীয় প্রফুল্ল সরদার, সাদরি সুষার অ্যাসোসিয়েশন অন্যতম কর্মকর্তা মাননীয় তাপস কুমার সরদার, পার্বতী মহিলা সমিতির সম্পাদক মাননীয় আশুতোষ সরদার, মাননীয় দুর্গাপদ মাহাতো, মাননীয় ভোলানাথ সরদার, মাননীয় সুবল চন্দ্র সরদার, মাননীয় শরৎ সরদার, মাননীয় কালিপদ সরদার, সহ একঝাঁক সাদরি সংগীত শিল্পী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকাগণ|

প্রথম দিন করম বৃক্ষের ডাল প্রতিস্থাপন ও করমতী যারা উপবাসে থেকে করম (কারাম) পূজোর আরাধনায় ব্রতী হয় তাদেরকে নিয়ে শুভ করম (কারাম) পরব অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন পাহান (আদিবাসী সমাজের পূজারি) হরিপদ সরদার| পাহান ধারমা ও কারমা’র ঘটনা বিজরিত কাহিনীর পরিসমাপ্তির পর শুরু হয় অতিথি আপায়ণ ও বরণ পর্ব। অঅতিথিদের চন্দন ফোঁটা, পুষ্পস্তবক ও ব্যাচ পরিয়ে বরণ করে নেয় সমিতির পক্ষ থেকে অলিকা, নন্দিতা, ত্রিপর্ণা ও অনুসিয়া।
প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও বাবাসাহেব ডাঃ বি. আর. আম্বেদকর ও ধারতি আবা ভগবান বীরসা মুন্ডার প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করেন সমিতির সভাপতি হরেকৃষ্ণ সরদার ও সম্পাদক রজনীকান্ত সরদার| উদ্বোধনী সংগীত পরিবেশন করেন হরিপদ সরদার।
সমিতির সভাপতির স্বাগত ভাষণ ও সম্পাদকের সাংগঠনিক ভাষণের পর বক্তব্য রাখেন অধ্যাপক দেবব্রত সিংহ| তাঁর বক্তব্যে সাদরি ভাষার স্বীকৃতি ও করম (কারাম) পূজো যে বৃক্ষ পূজনের প্রতীক সেই বিষয়টি তুলে ধরেন| প্রাচীনকাল থেকে আদিবাসীরা বৃক্ষকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করার যে কতটা প্রাসঙ্গিক তা তুলে ধরেন| বিডিও সৌরভ ঢাল্লা বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন যে আদিবাসীদের এই করম (কারাম) পূজোর অনুষ্ঠানের কথা এর আগে তিনি জানতেন না| তিনিও আদিবাসীদের শিক্ষার অগ্রগতির সাথে সাথে আদিবাসী সংস্কৃতিকে ধরে রাখার ক্ষেত্রে যৌক্তিকতা তুলে ধরেন| পঞ্চায়েত সচিব সঞ্জীব কান্ডার আদিবাসীদের সমৃদ্ধি কামনা করেন| কবি ও সাংবাদিক গালিব ইসলামের বক্তব্যে প্রকাশ পায় যে সোনারপুরের প্রথম করম (কারাম) পূজা থেকে প্রতি বছর তিনি যোগদান করেছেন| তিনি বলেন আদিবাসীদের এই অনুষ্ঠানে না আসলে তিনি জানতেই পারতেন না যে আদিবাসীদের আপায়ণ ও সুন্দর সাজানো গোছানো অনুষ্ঠান শুধু নয়, করম নৃত্যের ছন্দ, তাল, মাদল, ঢোলক এর ধ্বনিতে যে কেউ আকৃষ্ট ও মুগ্ধ হবেই| তিনি অকপটে স্বীকার করেন যে এই অনুষ্ঠান ছেড়ে যেতে মন কখনও চায় না| সমিতির মুখপত্র আদমিকের কাথা পত্রিকাটির মলাট উন্মোচন করেন কবি ও সাংবাদিক গালিব ইসলাম|
অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক শিক্ষক সত্যচরণ সরদার তাঁর বক্তব্যের মাঝে মাঝে করম (কারাম) পূজোর মাহাত্ম্য ও আদিবাসীরা কেন প্রাচীনকাল থেকে এই পূজা করে আসছে তা ব্যাখা করেন| আদিবাসীরা সহজ সরল ধ্যান ধারণা নিয়ে থাকে| তারা প্রকৃতির কোলে লালিত পালিত, প্রকৃতির থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়ে তোলে আপন সংস্কৃতি ও জীবন দর্শন। প্রকৃতির সাথে তাদের নিবিড় যোগ। যেহেতু প্রকৃতি তাদের বাঁচার সমস্ত রকম রসদ যুগিয়েছে তাই তাদের ধর্মীয় জীবনে প্রকৃতি দেবত্বের আসনে আসীন| মানুষের ক্ষুদ্র স্বার্থ চিন্তার অভিঘাতে যখন চারিদিকে চলছে নির্বিচারে বৃক্ষছেদন , জ্বলছে অরণ্য, বিশ্ব উষ্ণয়নে ঝলসাছে পৃথিবী, তখন প্রকৃতির ভূমিসন্তানরা প্রকৃতিকে রক্ষা করার অঙ্গীকার নিয়ে আরাধনা করে করম (কারাম) পূজার মতো বৃক্ষ পূজার অনুষ্ঠান। করম (কারাম) পূজোর বৃক্ষ পূজনের প্রতীক। মানব সভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে বৃক্ষের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ আদিকালে পূর্বপুরুষগণ করম (কারাম) পূজার অবতারণা করেছিলেন যার ধারা আজও পরম্পরাগত ভাবে উত্তরসূরির মাঝে প্রবহমান। বাংলার আদিবাসীদের প্রধান উৎসব করম (কারাম) পূজা| এই পুজো ভাদ্র মাসের শুক্লা একাদশী তিথিতে হয়ে থাকে। করম (কারাম) সংগীতে ভিন্ন ভিন্ন সুর তাল ছন্দে ধ্বনিত হয় দৈনন্দিন জীবনের সুখ দুঃখের কথা কখনও দার্শনিক তত্ত্বের কথা, কখনও আদিম জাতির ইতিহাসের কথা। পূজোর সাত দিন আগে থেকে মেয়েরা মাটির সরা বা ছোট ঝুড়ি বা চুপড়িতে বিভিন্ন দানা শস্য অঙ্কুরোদগমের উপযুক্ত পরিবেশে অঙ্কুরোদগম ঘটায়, একে জাওয়া বলে| অঙ্কুরিত জাওয়াকে প্রতিদিন আলো বাতাস দেখিয়ে হলুদ গোলা জলে সিঞ্চনের মাধ্যমে জাগরণ করে ও পূজোর দিন করম (কারাম) থানে রাখা হয়| জাওয়া করম (কারাম) এর প্রধান উপকরণ।
করম (কারাম) পূজার মাহাত্ম্য- আদিবাসীদের বিশ্বাস, নিষ্ঠার সঙ্গে এই পূজা করলে গৃহস্থের ঘর ধনসম্পদে যেমন ভরে যায় তেমনি নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তান লাভ হয়। গ্রামে সকলের মধ্যে সুসম্পর্ক বজায় থাকে। করম রাজার শুভ দৃষ্টি সমস্ত মানব জাতির উপর বর্ষিত হয়ে থাকে|

বক্তব্য পর্বের পর সারা রাত ধরে চলে করম নৃত্য ও সংগীত। করম নৃত্যে যেসমস্ত দল গুলো অংশগ্রহণ করে ছিল -১) উত্তর চব্বিশ পরগনার বাগদা থানার কোলা চারাতলা করম নৃত্যের দল, ২) পাথর প্রতিমা থানার পূর্ব দারোগাপুর মারাংবুরু মহিলা গোষ্ঠী, ৩) সোনারপুর আদিবাসী বীরসা মুন্ডা ঝুমুর দল, ৪) হরিপদ সরদার করম নৃত্য দল ছাড়াও স্থানীয় জনগণের করম নৃত্য ও সংগীত ধামসা মাদলের ধ্বনি আকাশে বাতাস ধ্বনিত হয়|
দ্বিতীয় দিনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পর মদনমোহন সরদার রচিত বাস্তবধর্মী নাটক ‘জান দেব তবু ধান দেব না’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়| নাটকটির নির্দেশনা করেন গোপাল চন্দ্র সাঁফুই, অভিনয়ে সমিতির কলাকুশলীবৃন্দ|
সংবাদ সূত্র – সত্যচরণ সরদার।

Loading