১৯৫৯ সালের ৩১শে আগস্ট-এর কথা। চারদিকে অনাহার, দুর্ভিক্ষের হাহাকার। কয়েক দিন আগেই কৃষক সভার নেতৃত্বে খাদ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ রেল স্টেশনে। স্থানীয় জমিদার-জোতদারের মদতে পুলিস প্রশাসন আন্দোলনকারীদের দেখলেই গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছে। গাঁয়ের আনাচে-কানাচে পৌঁছে গেছে সেই খবর। কিন্তু সারাদিন গতর-খাটা খেতোয়ালী পেটের জ্বালা পুলিশ প্রশাসনের হুমকি মানতে পারে না। পুলিস প্রশাসনের হুমকিতে তাই এতটুকু ভয় পায়নি অনন্তপুরের মতো হাজারো খেতোয়ালীর গাঁ। মরদের লড়াইয়ে কোমর বেঁধে নেমেছিলেন গাঁয়ের মেয়ে বউরাও।
সেদিন ছিলো শনিবার দুপুর ১টা। বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা অনন্তপুরের আদিবাসী পাড়ার মঙ্গল হাঁসদা দুধ বিক্রি করতে কালিয়াগঞ্জে যাচ্ছিলেন। যাবার পথে দেখতে পান গোরুর গাড়ি বোঝাই চাল পাচার হচ্ছে বাইরে। দুধের বাঁক ফেলে গলার শিরা ফুলিয়ে চিৎকার করে গ্রামের সবাইকে চাল পাচারের খবর জানান দিলেন। ইকপুকুরপাড়ের মাটির রাস্তায় গোরুর গাড়ির পথ আটকে দাঁড়ালেন নিজে ও তার বউ রাঁধুনি হেমব্রম। গোলমালের খবর পেয়ে স্থানীয় পুলিশ ক্যাম্প থেকে পুলিশ আসে। খবর যায় স্থানীয় চৌধুরীবাড়ির জমিদারী বাড়িতেও। পুলিস এসে গুলি ছুঁড়তে থাকে। পুলিশের গুলি এসে লাগে মঙ্গল হাঁসদার ডান হাতে। পুলিশের গুলিতে শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায় ৩৯ বছর বয়সী আদিবাসী রমণী রাঁধুনি হেমব্রমের। কচি কচি দুটি মেয়ে ছুটে আসে বাড়ি থেকে। মা তাদের আর কোনদিন ফিরবে না, বাবা আর বাঁকে করে দুধ দিতে যাবে না বড়লোকদের কালিয়াগঞ্জে।
পুলিসের গুলিতে ফুটো হওয়া দুই হাত নিয়ে বেশ কিছুদিন বেঁচেছিলেন মঙ্গল হাঁসদা। কোন বিচার বিভাগীয় তদন্ত হয়নি। উল্টে ৩৮ জন আদিবাসী কৃষকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা শুরু হয়েছিল।
অনন্তপুর গ্রাম কোনদিনও ভুলবে না শহিদ রাধুনি হেম্ব্রম ও মঙ্গল হাঁসদাকে। এই গ্রামের গৃহবধূ রাঁধুনি হেমব্রম খাদ্য আন্দোলনের প্রথম মহিলা শহীদ বলে দাবি করেন অনেকে। সেদিনের অকুতোভয় অনন্তপুর রক্তাক্ত হয়েছিলো একমুঠো চালের দাবিতে। জমিদারের জোটাল ভেঙে চাল জোগাড়ের লড়াইয়ে শামিল হয়েছিলেন রাঁধুনি হেমব্রমও। রাধুনির সেদিনের লড়াই ছিলো, কোনো বিক্ষিপ্ত ঘটনা নয়, আসলে এক শ্রেণীসংগ্রাম।
আজও শ্রদ্ধার সাথে সম্মান জানানোর রীতি আছে কৈপুকুর পাড়ের শহীদ রাঁধুনি হেমব্রমের শহীদবেদীতে। রাঁধুনি হেমব্রমের শহীদবেদীতে শ্রদ্ধা জানাতে আজও উপস্থিত থাকেন তাঁর দুই মেয়ে, বড় মাইদি হাঁসদা ও ছোট মাইদি হাঁসদা। বড় মেয়ে মাইদি থাকেন বাপের ভিটায় চার ছেলেমেয়ে নিয়ে, আর ছোট মেয়ে মাইদি থাকেন পতিরামের ভাতিন গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে।
সেদিন কি ভাবে কি হয়ে ছিল দু মেয়ের কিছু জানা না থাকলেও, বড় মেয়ে মাইদির শুধু মনে পড়ে বাপের ফুটো হাতের রক্ত মায়ের সিঁথির উপর টপটপ করে ঝরছে, বাবার কোলে মায়ের নিথর দেহ।
ঋণ স্বীকার – ফেসবুক সামাজিক মাধ্যমের Madhumita Dey এর পোষ্ট। ছবি – প্রতীকী।