LOADING

প্রকৃতি নির্ভর আদিবাসী খাদ্যাভ্যাস|

Spread the love


লিখেছেন – গৌরী টুডু|

প্রাণ ধারণের প্রাথমিক শর্ত হলো খাদ্য ও পানীয়। তবে মানুষ অন্যান্য প্রাণীদের মতো শুধু উদরপূর্তির জন্য খাদ্য গ্রহণ করেন না, তাদের প্রয়োজন রসনা তৃপ্তির। তাই এক এক ধরনের মানুষ, একেক একেক রকম খাবার খেয়ে থাকেন। আদিবাসীরা ঋতু অনুযায়ী যেসব খাবার খেয়ে থাকেন সেগুলি সুস্বাদু ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে|
বর্তমানে সরকারের রেশন ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে খাদ্য সংকট অনেক টা কমে এলেও আমরা সংবাদ মাধ্যমে জানতে পারি না খেয়ে মারা যাওয়া মানুষের কথা কিম্বা অপুষ্টি থেকে নানারকম অসুস্থতার কথা। বাস্তবিক দরিদ্র আদিবাসী ভাতের চালটুকু জোগাড় করতে সক্ষম হলেও বাজারজাত শাকসবজি, মাছ, মাংস, ফলমূল কিনে খাওয়ার ক্ষমতা তাদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো। এক্ষেত্রে তারা অনেকাংশেই নির্ভর করে মাঠ, ঘাট, নদীনালা, বন জঙ্গলের উপর। প্রকৃতি তাদের যখন যেরকম দেয় তারা তেমন খায়।
আদিবাসীরা নানারকমের শাক খান যেমন – কান্থা আড়াঃ, গারুন্ডি আড়াঃ, গান্ধারী আড়াঃ, জানুম আড়াঃ, হিন্চা আড়াঃ, ডাংরাকাটা আড়াঃ, গিমিা আড়াঃ, সিঞ্চ আড়াঃ, কিদুপ আড়াঃ, সিন্দৌরি আড়াঃ, বুজ আড়াঃ, হিসাঃ আড়াঃ ইত্যাদি। নানাধরনের শাকপাতা খেয়ে তারা তাদের আয়রন ও ভিটামিনের চাহিদা পূরণ করে থাকেন। মাছ, কাঁকড়া, গুগলি, বাড়িতে পোষা হাঁস, মুরগি, ছাগল, ভেড়ার মাংস, গরুর দুধ থেকে প্রোটিনের চাহিদা কিছু টা হলেও মেটে। বাড়ির লাগোয়া ছোট বাগানে তারা ঋতু অনুযায়ী চাষ করেন আলু, খাম আলু, বেগুন, ওল, টমেটো, লাউ, কুমড়ো, সিম| তাছাড়া জঙ্গল থেকে পান কাপু, ডুমুর, কুঞ্চডি(কচড়া) ইত্যাদি। এছাড়াও সোনা ব্যাং, কাদা মাছ, গোসাপ, কচ্ছপ, হাঁউ নামক পিঁপড়ের ডিম ও জঙ্গলের ছাতু অর্থাৎ মাসরুম আদিবাসীদের পরম প্রিয়।
আমরা আদিবাসীরা এসব খাবার খায় বলতে অনেকেই হয়তো লজ্জা পায় বা অনেকের হয়তো ঘৃণার উদ্রেক হয়। যদি কেউ একবার লাদ অর্থাৎ পাতা পোড়া (সেটা যদি কাঁচা শালপাতায় হয়ে থাকে) খেয়ে থাকে তবে কোনদিন তা ভুলতে পারবে না সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। বিভিন্ন ধরনের শাক থেকে শুরু করে মাছ, মাংসের পর্যন্ত পাতাপোড়া দারুণ লাগে। চালগুঁড়ি দিয়ে লেটো অর্থাৎ ঘণ্ট আদিবাসীদের সুস্বাদু খাবার। আতপ চাল দিয়ে কান্থা আড়াঃ দূর্দান্ত লাগে। পুজো পরবের সময় মাংস খিচুড়ি যাকে আমরা জেল সড়ে বলে থাকি, স্বাদে বিরিয়ানির থেকে কোন অংশে কম নয়। কাঁচা শালপাতায় চালগুড়ি ও মাংস দিয়ে আগুনে সেঁকে যে পিঠে তৈরি করা হয় তা আমাদের কাছে পাতড়া পিঠা নামে পরিচিত। পাতড়া পিঠা, ডুম্বু পিঠা, সুনুম পিঠা ছাড়া আদিবাসীদের উৎসব অপূর্ণ।
জঙ্গলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকমের ফল পাওয়া যায় কেন্দ পাকা, পিয়াল পাকা, জাম পাকা, তাল, খেজুর, বহু রকমের কুল তাঁরা সংগ্রহ করেন এবং আনন্দের সঙ্গে খেয়ে থাকেন এবং আমি হলফ করে বলতে পারি বাজারের দামি ফলের চেয়ে এগুলো অনেক বেশি সুস্বাদু। আমাদের বাড়িতে তৈরি হাঁড়িয়া, মাতকম পৌউরৌ (মহুয়ার মদ) ক্লান্তি দূর করতে অনেক বেশি নিরাপদ ও সুপেয়।
এতক্ষণ আমি আদিবাসীদের খাদ্যাভ্যাসের কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কেননা আদিবাসীদের খাবার মানেই অখাদ্য, কুখাদ্য বলে মনে করেন অনেকেই। তাদের বলি, আদিবাসীরা যেসব খাবার খেয়ে থাকেন সেগুলো বড় বড় রেস্টুরেন্টের থেকে অনেক বেশি সুস্বাদু ও খাদ্য গুণ সম্পন্ন। বাজারের প্যাকেটজাত খাবারে দেওয়া থাকে প্রিজারভেটিভ যা শরীরে মারণরোগ ক্যানসারের জন্ম দেয়। তাছাড়া বর্তমানে চাল, ডাল থেকে শুরু করে ফল, সবজি, সব কিছু তে এত বেশি রাসায়নিক সার, কীটনাশক, ওষুধ প্রয়োগ করা হচ্ছে যা মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই জেনেশুনে বিষ খাওয়ার থেকে আসুন না আদিবাসী সমাজের প্রচলিত খাদ্য ও খাদ্যবস্তুগুলি প্রচারের মাধ্যমে সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলি এবং সংরক্ষণের চেষ্টা করি । তবে বর্তমানে বন জঙ্গল কমে যাওয়ার ফলে আদিবাসীদের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিচ্ছে| তাই সর্বপ্রথম প্রয়োজন জঙ্গল রক্ষা করা। কারণ – “বন্যতার মধ্যেই রয়েছে এই পৃথিবীকে রক্ষা করার চাবিকাঠি।” – হেনরি ডেভিড থরো।

Loading